আমি যেমন ছিলাম....

অনেক লাজুক ছিলাম ছোটবেলায়। চুপচাপ থাকতাম, কারো সাথে বিশেষ কথাও বলা হত না। সবসময় একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে বসে থাকতাম। মোটাসোটা বাচ্চা ছিলাম, যেখানে বসায়ে রাখা হত সেখানেই চুপ ! চিন্তাভাবনাও ছিল দার্শনিক কিসিমেরই। ছোটবেলাতেই আমার বিজ্ঞতার কাহিনী পরিবারের সবার কাছে বেশ রসের উৎস হয়ে গেল। একটা উদাহরণ দিলেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

একবার মামা আসল বাসায়। তখন আমার বয়স আর কত, খুব বেশি হলে দুই বছর। মামার বেশ ভক্ত আমি, যখন যাই ঘটে তখন তাকে উৎসাহ নিয়ে এসে বলাই আমার কাজ। উত্তরবঙ্গের কনকনে শীতের রাত তখন। সবাই আড্ডা মারছে, আমি অন্য কোথাও গভীর মনযোগে কিছু করছি দেখে আমাকে কেউ আর ঘাটছে না। কিছুক্ষণ পরে আমি চোখেমুখে আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে ছুটে এসে বললাম মামা ! দেখে যাও !!

তারপরে আমার আবিষ্কারে মামা হতভম্ব হয়ে গেল। সেটা হচ্ছে আমি প্রাকৃতিক বড় কর্মটা সেরেছি মাটিতে এবং প্রচন্ড ঠান্ডায় সেটা থেকে হালকা ধোঁয়া বের হচ্ছে। মামা যখন হতবাক হয়ে আছে আমি তখন বিজ্ঞের মত মাথা দুলিয়ে বললাম, “মামা, আক্কা গরম”।

এই আবিষ্কারের কথা ছড়িয়ে যেতে সময় লাগলো না। তখন ফেসবুক থাকলে নিঃসন্দেহে এই কাহিনী দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে যেত। তারপরেও আমি মোটামুটি আইনস্টাইনের খ্যাতি পেয়ে গেলাম। আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী দেখা হলেই জিজ্ঞেস করে, কিরে আক্কা গরম ? আমি বলি হু অনেক গরম !

খাওয়াদাওয়ায় আমার কখনো অনীহা ছিলোনা। এখনকার পোলাপানকে তো দেখি খাওয়ানোর জন্য বাবা মায়ের কি অক্লান্ত প্রচেষ্টা! আমার সাথে সেরকম কখনো কিছু হয়েছে বলে মনে পড়েনা। একবার এক ডজন কলা আনা হল বাসায়। তারপরে আম্মু দেখে আমি একটু পরপরই কোথায় যেন যাচ্ছি, আম্মু পাত্তা দিল না। অনেকক্ষণ পরে একসময় তার খেয়াল হল আমার খিদা পায়না কেন ? তখন খেয়াল হল রান্নাঘরে রাখা কলার কাঁদি পুরোটা ফাঁকা। আমি, ২ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে, ২ ঘন্টায় পুরো ১২টা সাগর কলা খেয়ে ফেলেছি। আমার কলাপ্রীতি দেখে পরবর্তীতে আমাকে চুপচাপ কোথাও বসিয়ে রাখার জন্য সামনে বেশ কয়েকটা কলা দিয়ে রাখা হত। এখন অবশ্য সেই দক্ষতা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে, ২টা খেলেই হাঁসফাঁস লাগে !

আরেকবার, আমার এক চাচা এসেছেন বাসায়, সাথে আরেকজন। ২টা মাত্র মিষ্টি আছে বাসায়, আমি একটা খাবো বলে অনেকক্ষণ ধরেই ঝোলাঝুলি করছি কিন্তু মেহমানের সামনে তো আর একটা মিষ্টি দেওয়া যায় না। তাই আম্মু চাচাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলে দিলেন একটা মিষ্টি মেহমান খাওয়ার পরে বাকিটা আমার জন্য নিয়ে আসতে। আমি দুরুদুরু বুকে পর্দার পিছে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছি কখন আমি আমার মিষ্টিটা খাবো, মিষ্টিটা খেয়েই ফেলে নাকি ! পর্দার পিছে উত্তেজনায় আমার তখন যায় যায় অবস্থা। একসময় পরম বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম চাচাই মনের ভুলে দ্বিতীয় মিষ্টিটাও খেয়ে ফেললেন ! আমি যখন আম্মুর কাছে গিয়ে নালিশ লাগালাম তখন কান্নার শব্দে তার মনে পড়ল আমার কথা। কি সর্বনাশ, এখন তো আর পেট থেকে মিষ্টি বের করে দেয়া যায় না। অগত্যা দোকানে গিয়ে আবার পুরো এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে আনতে হল। আমারই লাভ হল, একটা আর খেতে হল না আমি বেশ কয়েকটা সাবড়ে দিলাম।

মিষ্টি নিয়ে গল্পের কোন অভাব নেই। সব মনে নেই কিন্তু আরেকটা মনে আছে। এটা সেই আক্কা গরম মামার সাথে। এখানে মিষ্টির প্যাকেট প্রায় শেষ, ৩টা আছে মাত্র। আম্মু মামার হাতে প্যাকেট দিয়ে বললেন তুমি একটা খাও, ওকে একটা খাওয়াও আর আরেকটা থাক। মামা যথারীতি চামচে গেঁথে আমার মুখের সামনে একটা ধরলেন কিন্তু আমি কোন কামড়ের বালাই না রেখে পুরোটা এক কামড়ে গিলে নিলম। মামা যখন নিজেরটা খেতে যাবে দেখে তখনও আমি হা করে আছি। মামা পিশাচ হতে পারল না, নিজের ভাগেরটাও আমাকে দিল। যখন উঠতে যাবে দেখে তখনও আমি হা। কি আর করা, শেষটাও আমার মুখেই গেল। কি আর করার আছে, বাচ্চা মানুষ। মামাকে আমি একটা গুতা দিলাম আমার দিকে তাকানোর জন্য, মামা তাকিয়ে দেখে আমি তখনও হা ! মামা আতকে উঠল, এখন কি দেবে ? আর কিছু না পেয়ে মামা আমার মুখে পানির গ্লাস লাগিয়ে দিল।

যতই গম্ভীর হই আর মজার মজার কান্ড করি আমার লজ্জা কিন্তু কখনোই কম ছিল না। প্রথম দিন ক্লাসের প্রথম ঘন্টার পরে আমি ক্লাস থেকে ব্যাগ নিয়ে ছিটকে বের হয়ে আসলাম। একদৌড়ে বাইরে বসা আম্মুর কাছে, পিছন পিছন মিস দৌড়ে আসলেন। সে এক দেখার মত দৃশ্য। আমি আম্মুর কাছে এসে কান্না, আম্মু আমি ক্লাস করবো না। নিরস্ত করতে না পেরে আমাকে সেদিনের মত বাসায় নিয়ে আসা হল। আম্মু জিজ্ঞেস করল বাবা তুমি ভয় পেয়েছিলা ? আমি বললাম না আমার হিসু পেয়েছিল।

সেই লাজুক আমি যখন একদিন জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার জন্য সামনে গিয়ে আরো কয়েকজনের সাথে দাঁড়ালাম তখন আম্মু আমাকে দেখে টাসকি খেয়ে গেল। তখন কারো সাথে দেখা হলেই আম্মু সেটা সবাইকে গর্ব করে বলত, আমি আর কখনো আম্মুর ভুল ভাঙাইনি। আমাকে যখন ম্যাডাম সামনে যাওয়ার জন্য ডাক দিলেন আমি ভেবেছিলাম পিটি শেষ, ক্লাসে যাওয়ার জন্য ডাকছেন আমাকে। কে জানত আমাকে গান গাইতে হবে ?

কেন জানি না, কিন্তু যেখানেই যেতাম আমাকে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা খুব পছন্দ করত। মনে হয় কিউট বাচ্চা ছিলাম এজন্য,এহেম এহেম ! আমি সবসময়ই মেয়ে ফ্রেন্ডদের কাছে একটু বেশি সুবিধা পেয়েছি, ছোটকালে অবশ্য ! এখন আর কেউ বেশি হেল্প করে না, হেহে !

শিশুকালে আমার জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মেয়ের প্রেম উপচে উঠত ! ক্লাসে আমার সাথে যারা টিফিন শেয়ার করতো তারা সব মেয়ে, ছেলেরা তখন ঈর্ষান্বিত হয়ে দূরত্ব বজায় রাখতো। কারো সাথেই অবশ্য আমার বন্ধুত্ব নিজে থেকে হত না, লজ্জায় আমার মুখে কথা ফুটতো না তাই ওরাই এসে আমার সাথে কথা বলত। এখন অবশ্য প্রেক্ষাপট আলাদা, আমিই কথা বলি হেহে। এখনো প্রেম উঠে হয়তো কারো কিন্তু হায়, তাদের কি সাহস নাই যে কিনা এই একাকী যুবককে এখন প্রেম নিবেদন করবে?

প্রেমের বিড়ম্বনা একেবারে হয়নি তা নয় । বাল্যকালে একজনকে ভালো লেগেছিল...হে হে হে ! বিকালে সাইকেল চালাতাম সাইসাই করে তার সামনে দিয়ে, ওই বয়সে সেটাই আমার পালসার ! তো সেরকম এক রোমান্টিক বিকেলে যখন আমি সাইকেল চালাচ্ছি তখন দেখি সে রাস্তায় হাটছে। আমি স্পীড তুঙ্গে তুলে তার কাছে গেলাম....এবং একদম পাশে গিয়ে ধাড়ুম ধুড়ুম করে সাইকেল সহ পড়ে গেলাম। তারপরে একটু ধাতস্থ হয়ে সাইকেল তুলে একটা ড্যাম কেয়ার হাসি দিয়ে সাইকেল ঠেলে নিয়ে হাটা ধরলাম...যখন পিছনে হাসি শুরু হল তখন কনুইয়ের চিনচিনে ব্যথায় খেয়াল হল আমার সারা গায়ে কেটে গেছে। আমার প্রেমের সেখানেই ইতি তবে আমার র‌্যাম্বো মার্কা স্টান্ট দেখে সেই নায়িকা পটেছিল কিনা জানা যায়নি। কে জানে ?


তারপরের বয়সগুলোর কাহিনী সেভাবে আর বিশেষ কিছু নয়....বড় হওয়ার সাথে সাথে তো সেগুলো বড়কালের কাহিনী হয়ে উঠতে থাকে। এগুলো নিয়ে হয়তো বুড়োকালে গিয়ে আরেকটা গল্প লেখা যেতে পারে। ততদিন হোক না আরও কিছুর মজার অভিজ্ঞতা !

Comments

Popular posts from this blog

দিনের আলোর মাঝেই লুকিয়ে থাকে রাতের আধার।

চৌহালীতে 'সচেতন ছাত্র সমাজ(CSS)' এর ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত

এই তো, এটাই আমি..

পাশেই তো আছি...

সুর ও ছন্দের দিনগুলো...

বোধহয় ভুলে যাওয়াটাই ঠিক, মনে করা বা মনে রাখাটাই অস্বাভাবিক....

সেজন্যে, অপেক্ষা করার আসলে একটা লিমিট থাকা উচিৎ

ইচ্ছে ছিলো